Saturday, 16 November 2019

মানহীন ইনসুলিনে ঝুঁকিতে রোগীরা

অতিরিক্ত লাভের আশায় বাজারে ছাড়া হচ্ছে নকল ইনসুলিন বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসার অন্যতম অনুসঙ্গ ইনসুলিন। সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে একজন ডায়াবেটিস রোগীকে অন্যান্য নিয়ম পালনের পাশাপাশি নিয়মিত ইনসুলিন নিতে হয়। টাইপ-১ রোগীদের বেঁচে থাকতে ইনসুলিন তো খাবারের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই ইনসুলিন যদি নকল হয় বা মানহীন হয় তাহলে রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হয়ে পড়তে পারে ঝুঁকিপূর্ণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মর্ডান ইনসুলিনের দাম কিছুটা বেশি। তাই কিছু বিদেশী কোম্পানির মর্ডান ইনসুলিনের নকল বাজারে পাওয়া যায়। তাছাড়া এসব ইনসুলিনের চাহিদা বেশি থাকায় এবং লাভ বেশি হওয়ায় অনেকে বিদেশ থেকে অবৈধভাবে লাগেসে ভর্তি করে ইনসুলিন নিয়ে আসে। কিন্তু ইনসুলিন নির্দিষ্ট তামপাত্রায় ‘কোল্ড চেইন’ সংরক্ষণ করা না হলে এটি দ্রæত নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এটি হয় মানহীন এবং কোনো কার্যকরিতা থাকে না। আবার বেশিরভাগ দোকানে ইনসুলিন নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় রাখা হয় না। ফলে সেগুলোও মানহীন হয়ে পড়ে। তাই এসব ইনসুলিন ব্যবহার করে রোগীর কোনো সুফল পান না।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ জানান, বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি ইনসুলিন তৈরি করছে। কিন্তু এসব ইনসুলিনের কোনো বায়োইকুইভেলেন্স পরীক্ষা নেই। এমনকি এটি কত মাত্রায় ব্যবহার করা হলে ব্লাড সুগার কতটা নিয়ন্ত্রণ হবে সে বিষয়েও কোনো গবেষণা নেই। আবার এসব কোম্পানি ক্ষমতার অপব্যবহার করে চিকিৎসকদের তাদের ইনসুলিন ব্যবস্থাপত্রে লিখতে ডাক্তারদের বাধ্য করছে। এমনকি তারাই বিভিন্ন অপকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে বিদেশী কোম্পানিগুলোকে এ দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য করছে। ফলে দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ ডায়াবেটিস রোগীরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহাজাদা সেলিম বলেন, বিদেশী কোম্পানির মর্ডান ইনসুলিনগুলোর নকল পাওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে সেটি নির্ণয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। কারণ ওইসব কোম্পানি একেক দেশের জন্য একেকটি নির্দিষ্ট ব্যাচ তৈরি করে। লাগেসে করে যেসব ইনসুলিন আনা হয়, সেগুলো বিক্রির আগেই কোল্ড চেইন না মানায় নষ্ট হয়ে যায়। আর দেশী কোম্পানির ইনসুলিনের বিষয়ে তিনি বলেন, দেশী কোম্পানির ইনসুলিনের কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তাই এসব ইনসুলিন নিয়ে আরও গবেষণা করা প্রয়োজন।
এ ধরনের ইনসুলিন ব্যবহারে রোগীদের কি ধরনের ক্ষতি হতে পারে জানতে চাইলে ডা. শাহাজাদা সেলিম বলেন, ইনসুলিন নকল বা মানহীন হলে টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের মৃত্যু ঘটান শঙ্কা থেকে যায়। টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে শরীরে এলার্জির প্রভাব বাড়তে পারে, চুলকানি, ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। এমনকি নানা ধরনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্থায়ী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা জানান, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট উদ্যোগী এবং বিভিন্নমাত্রায় সফল। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। অর্থাৎ বাংলাদেশের ডায়াবেটিস রোগীরা তুলানমূলক খারাপ অবস্থায় জীবন যাপন করছে। এযাবৎ কালে প্রকাশিত দু’টি গবেষণালব্ধ প্রবন্ধে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের বিশ শতাংশের কম রোগী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সফল। এটিই বর্তমান বিশ্বের যে কোনো দেশের ডায়াবেটিস রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাত্রার তুলনায় খারাপ অবস্থা। ডায়াবেটিসের দীর্ঘকালীন জটিলতাগুলোতেও বাংলাদেশী রোগীরা বেশি ভুগছে। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক পরিস্থিতি হলো, এখানে অতি অল্প বয়সে মানুষ (ছেলে-মেয়েরা) টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী কিশোর-কিশোরী ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে বসবাস করছে। বাংলাদেশের আরও একটি বড় ঝুঁকি হলোÑ বিপুলসংখ্যক গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগী, পৃথিবীতে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের হার বাংলাদেশে তুলনামূলক বেশি।
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৪২ কোটিরও বেশি। ডায়াবেটিস বহুলাংশেই (৮০ ভাগ পর্যন্ত) প্রতিরোধযোগ্য, ফলে এখনই যদি এ রোগের প্রতিরোধ না করা যায়, তাহলে এই সংখ্যা ২০৪০ সাল নাগাদ প্রায় ৬৪ কোটিতে পৌঁছানোর আশঙ্কা করছে সংস্থাটি। আইডিএফ তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে এ দেশে ৭৩ লাখেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। যাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই মহিলা। তা ছাড়া, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এমন অর্ধেকেরও বেশি লোক জানেই না যে তাদের ডায়াবেটিস আছে।

EID MUBARAK